দৈনিক সহযাত্রী

রফিকুল নাজিম : খুব সকাল সকাল তিনু ঘুম থেকে উঠে চটজলদি হাতমুখ ধুয়ে দক্ষিণের বারান্দায় যায়। পিকু’র সাথে কথা বলে। তাকে খাবারদাবার দেয়। পিকুও লেজ নাড়িয়ে- ঠোঁট বাড়িয়ে তিনুকে সকালের উষ্ণ ভালোবাসা জানায়। পিকুর এমন ভালোবাসায় তিনুও গদোগদো হয়। সকালের এই সময়কে তিনু দারুণ উপভোগ করে। তারপর চলে পিকুকে শিক্ষিত করে তোলার অভিযান। এই অভিযানে পিকুর মাস্টার মশাইয়ের ভূমিকায় থাকে তিনু। সে যা বলে পিকুও হুবহু তাই বলার চেষ্টা করে।

তিনুর বয়স দশ। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ভালো ছাত্রী হিসেবে শিক্ষকরা তাকে খুব আদর করে। তিনুও সবসময় তাদের ভালোবাসা পেতে চায়। তিনুর বাবা- হাসান সাহেব সিলেট সদর উপজেলার একটি সরকারি দপ্তরে চাকরি করে। কেরানি পদে। তিনি প্রতি সপ্তাহে বাসায় আসেন। তিনুর মা- মমতাজ খানম শহরের নামীদামী একটা স্কুলের শিক্ষক। তাই স্কুল থেকে ফিরে তিনুকে একা সময় কাটাতে হয়। যদিও বাসায় তাকে দেখাশোনা করার জন্য রহিমা আছে। কিন্তু রহিমা তো সারাদিন বাসার কাজকাম নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তাই পিকুর সাথেই কথা বলে তার সময় কাটে। তিনুর বাবা গত জন্মদিনে তাকে এই ময়না পাখি উপহার দিয়েছে। অল্পদিনেই তাদের দু’জনের মধ্যে দারুণ ভাব হয়েছে।

পিকুর একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে। তিনুর বাসার সবাই এই কথা জানে। পিকুর সামনে কেউ কথা বললে পিকু বলে দিতে পারে- কথাটা সত্যি নাকি মিথ্যা! আর এ কারণে তিনুর বাসার কেউ এখন পিকুর সামনে কথা বলতে চায় না। এমন কী বারান্দায় পর্যন্ত কেউ আসতে চায় না। আসলেও মুখ খোলে না। একবার কী হলো- তিনুর মায়ের মোবাইল ফোন বাসা থেকে খোয়া যায়। কিন্তু এই কাজটি কে করেছে- কেউ বুঝে উঠতে পারছিলো না। বাসায় চারজন মানুষ ছাড়া আর কেউ ঐদিন বাসায় আসেনি। তখন বাসায় কাজ করতো মনোয়ারা নামের একজন। সবাই মনোয়ারাকে সন্দেহ করলো। কিন্তু মনোয়ারা কিছুতেই স্বীকার করছিলো না। পরে তিনু মনোয়ারাকে দক্ষিণের বারান্দায় নিয়ে গিয়ে চুপিচুপি মোবাইল চুরির বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে সে নেয়নি বলে জানায়। কিন্তু পাশ থেকে পিকু হঠাৎ বলে উঠলো- ‘মনু, তুমি মিথ্যা বলো কেন? মিথ্যা বলা মহাপাপ। মিথ্যা কথা বললে তুমি বেহেশতে যাইতে পারবা না।’ মনোয়ারা তো বেহেশতের কথা শুনে থতমত খেয়ে গেল। তার আবার বেহেশতে যাওয়ার খুব ইচ্ছে। পরক্ষণে সে কান্না করে দিলো। সে মোবাইল ফেরত দিয়ে তিনুর মায়ের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলো। তিনুর মা কিছু টাকা পয়সা দিয়ে মনোয়ারাকে বাসা থেকে বিদায় করে দেন। তারপরই এই বাসায় রহিমা আসে। রহিমাও পিকুর বিষয়টা জানে। তাই হয়তো তার হাত খুব পরিষ্কার রাখে সবসময়।

তিনু বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আজ তার বাবা আসবে। সপ্তাহের শুক্রবার ও শনিবার তাদের বাসায় চাঁদের হাট বসে। হাসান সাহেব বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম করছিলেন। তিনু বাবার বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে। কিচ্ছু বলছে না। অন্যসময় তো তিনুর বকবকানি শুনে শুনে তিনি কিছুটা বিরক্ত হয়ে যান। তিনুর শরীর ঠিকঠাক আছে কিনা যাচাই করার জন্য তিনি তিনুর কপালে হাত রেখে দেখলেন। না। ঠিকই তো আছে!

-তিনু সোনা, কি হয়েছে তোমার ? বাবার সাথে কথা বলছো না কেন?

-আমার ভালো লাগছে না, বাবা।

-কেন, মা ? কি হয়েছে- বাবাকে বলো?

-না। থাক। বলা যাবে না।

-কেন, মা? বলো বাবাকে।

– -আচ্ছা বাবা, তোমাকে আমি একটা প্রশ্ন করবো। তুমি ঠিকঠাক উত্তর দিবে ত?

-হ্যাঁ। কেন দিবো না? আমার মা প্রশ্ন করেই দেখুক।

-না, বাবা এখানে না। চলো বারান্দায় যাই।

-এখানেই করো। বারান্দায় যেতে হবে কেন?

-না। এখানে বলা যাবে না। পিকুর সামনে চলো।

অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাসান সাহেব বারান্দায় গেলেন। সাথে তিনুর মা। পিকুও ঠোঁট বাড়িয়ে সবাইকে স্বাগত জানায়। অনেকদিন পর সবাইকে বারান্দায় একসাথে দেখে তারও ভালো লাগছে।

– জানো, বাবা- আমার বন্ধুর মায়েরা তোমাকে ছোট করে কথা বলে। তখন আমার খুব কষ্ট হয়।

– ওনারা কি বলে?

– ওনারা বলেন, তুমি নাকি ঘুষ খাও। তাই নাকি আমাকে এতো নামিদামি স্কুলে পড়াতে পারছো। আমি বলেছি- আমার বাবা অ-নে-ক ভালো। তুমি পৃথিবীর সেরা বাবা। বলো বাবা- আমি সত্যি বলেছি না?

হাসান সাহেব কোনো কথা বলতে পারছেন না। তার হাত-পা কাঁপছে। সমস্ত শরীর কাঁপছে। গলা ধরে আসছে। প্রচ- চিৎকার করে তারও বলতে ইচ্ছে করছে- তিনুর কথাই সত্যি। কিন্তু কথাটা তার গলা দিয়ে আসছে না। তিনু বারবার হাসান সাহেবের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করছে-

– বাবা, বলো আমার কথাটাই সত্যি।

পিকু মাথাটা নিচু করে আস্তে করে বলে, ‘বাবা ঘুষ খায়।’

হাসান সাহেব শিশুর মতো কাঁদছেন। তিনুর মা-ও কাঁদছেন। অপলক দৃষ্টিতে তিনু তার বাবাকে দেখছে। ভীষণ অপরিচিত লাগছে বাবাকে। হাসান সাহেব তিনুকে কোলে নিয়ে বলেন, ‘মাগো, আমি আজ থেকে আর ঘুষ খাবো না- এই কান ধরে বলছি।’ পিকু চিও চিও করে বলে, ‘বাবা, সত্য কথা বলেছেন।’ পিকুর কথা শুনে সবাই সমস্বরে হাসতে থাকে। যেন হাসির বান ডেকেছে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter