সহযাত্রী ডেস্ক: চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার ৩ দিন পর একটি হত্যা মামলা করা হয়েছে। নিহত সাইফুলের বাবা জামাল উদ্দিন বাদী হয়ে শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে নগরীর কোতোয়ালি থানায় এই মামলা করেন। মামলায় ৩১ জনকে সুনির্দিষ্ট আসামি করা হয়েছে। এতে অজ্ঞাতনামা আরও ১৫ জনকে আসামি করা হয়। মামলার নম্বর ৪৬। এছাড়া আইনজীবী ও বিচার প্রার্থীদের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর, মসজিদ ভাঙচুরসহ বিভিন্ন অভিযোগে নিহত সাইফুলের ভাই খানে আলম বাদী হয়ে পৃথক একটি মামলা করেন। এই মামলায় ১১৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
অজ্ঞাতনামা আসামি দেখানো হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে। এদিকে হত্যা মামলা করার পর সাইফুল ইসলামের বাবা জামাল উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, আমার ছেলে হত্যায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে যেন দেশের প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। আমি সরকারের কাছে এ দাবি জানাচ্ছি। আমার একটাই দাবি। সাইফুল ইসলামের ভাই খানে আলম বলেন, আমরা চাই দ্রুত সময়ের মধ্যে দোষীদের গ্রেফতার করে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রয়োগের মাধ্যমে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হোক।
ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভুকে গ্রেফতার ও তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করাকে কেন্দ্র করে হামলা, ভাঙচুরসহ বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধে আরও তিনটি মামলা হয়েছিল। সব মিলিয়ে এ নিয়ে ৫টি মামলা করা হলো। এসব মামলায় মোট আসামি করা হয়েছে ২০৪৬ জনকে। শুক্রবার দায়ের করা ভাঙচুর ও হামলার মামলায় ১১৬ জনের মধ্যে অন্তত ৬৫ জন আইনজীবী রয়েছেন। তাদের প্রায় সবাই সনাতন ধর্মাবলম্বী বলে জানা গেছে। এছাড়া দৈনিক আজাদীর সিনিয়র রিপোর্টার শুকলাল দাশসহ দুই সাংবাদিককেও এই মামলায় আসামি করা হয়েছে।
হত্যা মামলার আসামি যারা : শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে নিহত আইনজীবী সাইফুলের বাবা জামাল উদ্দিনের করা হত্যা মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে-আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের ইন্ধনে ইসকনের সন্ত্রাসীরা আইনজীবী সাইফুলকে হত্যা করেছে। মামলাটি পেনাল কোডের ১৪৭/১৪৮/১৪৯/৩০২/৩৪ ১৮৬০ ধারায় রুজু করা হয়েছে।
এই মামলার সুনির্দিষ্ট আসামিরা হচ্ছেন-নগরীর কোতোয়ালি থানার বান্ডেল রোড সেবক কলোনির বাসিন্দা চন্দন, আমান দাস, শুভ কান্তি দাস, বুঞ্জা, রনব, বিধান, বিকাশ, রমিত, রুমিত দাশ, নয়ন দাস, গগন দাস, বিশাল দাস, ওমকার দাস, বিশাল, রাজকাপুর, লালা, সামির, সোহেল দাস, শিব কুমার, বিগলাল, পরাশ, গণেশ, ওম দাস, পপি, অজয়, দেবী চরণ, দেব, জয়, দুর্লভ দাস ও রাজীব ভট্টাচার্য। সুনির্দিষ্ট এই ৩১ জন ছাড়াও এই মামলায় অজ্ঞাতানামা আরও ১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে যা বলা হয়েছে : এজাহারে বলা হয়, ২৬ নভেম্বর রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইসকনপন্থি আইনজীবীরা ক্ষুব্ধ হয়ে আদালতকে উদ্দেশ করে অশালীন ভাষায় আজেবাজে মন্তব্য করে। তারা আদালতে হট্টগোল সৃষ্টি করে। তখন চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের অনুসারী এজাহারনামীয় এবং অজ্ঞাতনামা আসামিরা প্রিজন ভ্যানের সামনে অবস্থান করে দায়িত্বরত পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা প্রদান করে। একপর্যায়ে অতিরিক্ত পুলিশ ফোর্স, আনসার ও বিজিবি এসে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে আসামিরা বিভিন্ন উসকানিমূলক স্লোগান দিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে ত্রাস সৃষ্টি করে। তারা আদালত প্রাঙ্গণে রাখা আইনজীবী, বিচার প্রার্থী ও সরকারি গাড়িসহ আনুমানিক ২০-৩০টি গাড়ি ভাঙচুর করে।
তারা কোর্ট বিল্ডিং জামে মসজিদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পূর্বপরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মসজিদে ইট-পাটকেল ও পাথর নিক্ষেপ করে মসজিদের গ্লাস ভাঙচুর করেন এবং মুসল্লিদের আহত করে। পরে আসামিরা একত্রিত হয়ে একই উদ্দেশ্য সিদ্ধিকল্পে ত্রিশূল, রাম-দা, কিরিচ, বঁটি, লোহার রড, হকিস্টিক, লাঠিসোঁটা ও নানাবিধ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ দাঙ্গার সাজে সজ্জিত হয়ে আদালত ভবনের প্রবেশ মুখে রাস্তার ওপর অবস্থান করে। আমার ছেলে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম আলিফ নিরাপদে বাসায় ফিরে যাওয়ার উদ্দেশে চট্টগ্রাম আদালত ভবন থেকে নেমে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। ২৬ নভেম্বর বিকাল সাড়ে ৪টার সময় কোতোয়ালি থানাধীন এসি দত্ত লেনের নিলয় স্বজন বিল্ডিংয়ের পাশে জামাল উদ্দিন আহমেদের বিল্ডিংয়ের গেটের সামনে পাকা রাস্তার ওপর পৌঁছামাত্র তার মুখে দাড়ি এবং আইনজীবীর পোশাক দেখে আসামিরা বহিষ্কৃত ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর নামে জয়ধ্বনি দেয়।
এ সময় তাদের হাতে থাকা ধারালো কিরিচ, রাম-দা, ত্রিশূল ও বঁটি সহকারে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আমার ছেলে মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম আলিফের ঘাড়ে, মাথায়, পিঠে, পায়েসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে এলোপাতাড়ি নির্মমভাবে কুপিয়ে গুরুতর রক্তাক্ত জখম করে। আসামিরা আমার ছেলের মৃত্যু নিশ্চিত করে নারকীয় উল্লাস করতে করতে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। স্থানীয় লোকজন ও ছেলের সহকর্মীদের বরাতে বাদী এজাহারে আরও উল্লেখ করেন, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ ও দলটির অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ইন্ধনে আসামিরা তার ছেলেকে হত্যা করেছে।
আদালতে ভাঙচুর ও ত্রাস সৃষ্টির অভিযোগে আরও এক মামলা : ইসকনের চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে কারাগারে পাঠানোকে কন্দ্রে করে আদালত প্রাঙ্গণে ত্রাস সৃষ্টির অভিযোগে আরও একটি মামলা হয়েছে। সংঘর্ষের মধ্যে নির্মম হত্যার শিকার আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের ভাই খানে আলম বাদী হয়ে শুক্রবার রাতে নগরীর কোতোয়ালি থানায় মামলাটি করেন। মামলার এজাহারে ১১৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
অজ্ঞাতনামা আরও ৪০০-৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৬৫ জন আইনজীবী রয়েছেন। আদালতের সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজ সংগ্রহ করেই হামলা ভাঙচুরে জড়িত এসব আইনজীবীকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে এজাহার প্রস্তুতকারী সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান। দুই সাংবাদিকের মধ্যে রয়েছেন দৈনিক আজাদীর সিনিয়র রিপোর্টার শুকলাল দাশ ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল চট্টগ্রাম প্রতিদিনের প্রকাশক আয়ান শর্মা।
পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর ও সরকারি কাজে বাধাদানসহ একাধিক অপরাধে এর আগে আরও তিনটি মামলা হয় কোতোয়ালি থানায়। এসব মামলায় ৭৭ জনের নাম উল্লেখসহ ১ হাজার ৪০০ জনকে আসামি করা হয়।