দৈনিক সহযাত্রী

শিরোনাম

ঋণের জালে আটকে যাচ্ছে জীবন, মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে নাকাল সাধারণ মানুষ।

এইচ এম আকতার: মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে দেশের মানুষ। এ কলে বেশি পিষ্ট হচ্ছে গ্রামের মানুষ। শহরের তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি হচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, মানুষের জীবন আর চলছে না। জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে নাকাল অবস্থায় রয়েছেন দেশের সাধারণ মানুষ। ব্যয় সামাল দিতে না পেরে ভোগ কমিয়ে কোনোরকমে জীবন টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন স্বল্প ও নিম্নআয়ের মানুষ। যে হারে নিত্যপণ্যের দাম1 বাড়ছে সে হারে মজুরি(আয়) বাড়ছে না। এতে করে মানুষ দৈনন্দিন তালিকা থেকে পুষ্টিকর খাবার বাদ পড়ছে। সংসার চালাতে নতুন করে ঋণের জালে আটকে যাচ্ছে।

গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ খেটে খাওয়া দিনমজুর মানুষ যাদের কোন কৃষি জমি নেই তারা সবচেয়ে বেশি কষ্টে রয়েছে। তারা প্রতিদিন যে আয় করে থাকেন তা দিয়ে তাদের সংসার আর চলে না। একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে যারা কম বেতনে বেসরকারি চাকরি করছে যাদের বেতন বাড়ছে না। তারা বলছে প্রতিদিনই কোন না কোন পণ্যের দাম বাড়ছে। এতে করে তারা পুষ্টিগুণ রয়েছে এমন খাবার খেতে পারছে না। মাছ আর গোস্ত বাদ দিয়ে সাক-সবজি আর আলু ভর্তা খেতে হচ্ছে। অনেকে ঋণ করে সংসার চালাতে বাধ্য হচ্ছে। এতে করে মানুষ ঋণের জালে আটকে যাচ্ছে। এ অবস্থা আর কত দিন চলবে তা কারো জানা নেই।

এক ধাক্কায় জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বেড়ে গিয়ে অসহনীয় পরিস্থিতি তৈরি করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এর ফলে সাম্প্রতিক সময়ে বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির পারদ এবার দুই অঙ্কের ঘরে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা। এ ছাড়া উৎপাদন ব্যয় আরও বেড়ে গিয়ে বড়ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে শিল্পকারখানায়। পণ্যমূল্য বেড়ে গিয়ে দেশের রপ্তানি খাত প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে বলেও মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সম্পর্কে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চেয়ারম্যান ড. গোলাম রহমান বলেন, মূল্যস্ফীতি তো বাড়ছে, এখন ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি হবে। স্বাভাবিকভাবেই যাদের আয় সে হারে বাড়বে না, তাদের অবস্থার দ্রুত অবনতি হবে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, নির্ধারিত আয়ের মানুষ ও পেনশনভোগীরা এ দুর্ভোগে পড়বে। যারা সঞ্চয়পত্র ও স্থায়ী আমানতের আয় দিয়ে চলেন, তাদের জীবনমান ও জীবন ধারণে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর ফলে সরকারের যে অনেক বড় বড় অর্জন আছে তা মøান হয়ে যাবে। একটা অশান্ত, অস্বস্তিকর পরিস্থিতি অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে পড়াটাও বিচিত্র কিছু হবে না।

তিনি আরও বলেন, কাদের সন্তুষ্ট করার জন্য তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে বুঝতে পারছি না। সম্ভবত আইএমএফকে সন্তুষ্ট করার জন্য করা হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো কোনোভাবেই যৌক্তিক বলে মনে হয় না। পর্বতসম ভুল সিদ্ধান্ত। এর আগে সারের দাম বাড়ানো হয়েছে। সব সিদ্ধান্তই হচ্ছে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির জন্য। কোনো সিদ্ধান্তই সাধারণ মানুষকে স্বস্তির সংবাদ দিচ্ছে না।

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, গত তিন মাসে ধারাবাহিকভাবে মূল্যস্ফীতি কমছে। ডিসেম্বরে আরও কমবে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে। বাংলাদেশে অবশ্যই তার প্রভাব পড়বে। ধান ও সবজি উৎপাদন ভালো হয়েছে। সরকার জ্বালানি কেনে এবং বিক্রি করে। সামাজিক ও বাস্তব কারণে দাম বাড়াতে হয়। বিশ্ববাজারে দাম কমলে আজ হোক বা কাল দেশেও দাম কমবে। তিনি বলেন, সরকারের মূল লক্ষ্য খাদ্য মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখা এবং দরিদ্র মানুষ যাতে স্বস্তিতে থাকতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা।

পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, নবেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ, যা অক্টোবরে ছিল ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। নবেম্বরে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১৪ শতাংশে, যা আগের মাসে ছিল ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ।

খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি অবশ্য বেড়েছে। গত মাসে খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ, যা তার আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এ সময়ে বেড়েছে মজুরি হার। নবেম্বরে মজুরি বেড়েছে ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ, যা তার আগের মাসে বেড়েছিল ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। এম এ মান্নান জানান, এ সময়ে শহরের তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। নবেম্বরে গ্রামের সার্বিক মূল্যস্ফীতি শূন্য দশমিক ২ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ হয়েছে, যা আগের মাসে ছিল ৮ দশমিক ৯২ শতাংশ। এ সময়ে শহরের মূল্যস্ফীতি শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭০ শতাংশে, যা আগের মাসে ছিল ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ২৩ শতাংশ, যা আগের মাসে ছিল ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৩১ শতাংশে, তার আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। বাজারে প্রতিনিয়তই খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। বাজারের সঙ্গে বিবিএসের তথ্যের মিল নেই। নবেম্বরে অত্যন্ত ভালো ছিল। মূল্যস্ফীতি ডিসেম্বরে আরও কমার সম্ভাবনা আছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান, শাকসবজি হওয়ার পাশাপাশি তেল-গ্যাসের দামও বিশ্বব্যাপী কমছে। সার্বিকভাবে প্রবৃদ্ধিও ৭ শতাংশে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বর্তমানে ৪২২টি পণ্যের ওপর মূল্যস্ফীতি যাচাই করা হয়। এখন সেগুলো আবার পুনর্বিবেচনা করা হবে। কেননা, এখানে স্বর্ণের দামও ধরা হয়েছে। স্বর্ণের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়ে। এ ছাড়া মাখন, কফিসহ এ রকম অনেক পণ্যের দামও ধরা হয়। এগুলো সংশোধন করা হবে। তেল-গ্যাস সরকার নিজে কিনে বিক্রি করে। সরকার কোনো মহাজন নয়। এটা নিয়ে লাভ করবে না। বিশ্ববাজারে দাম কমলে অবশ্যই সরকার কমাতে বাধ্য হবে। মূল্যস্ফীতি পরিমাপকের সূচকগুলো পর্যালোচনা করবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এমন কিছু পণ্য, যা নিত্যপ্রয়োজনীয় নয়, এ তালিকায় সেগুলো রাখা হবে কিনা, তা ভাবা হবে। এদিকে নবেম্বরে মজুরি হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। কৃষি খাতে মজুরি হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৯০ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ। শিল্প খাতে মজুরি হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ। সেবা খাতে মজুরি হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ১৭ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ।

এদিকে ব্যাংকের টাকা নামে বেনামে ভুয়া প্রতিষ্ঠান তুলে নিচ্ছে। এমন সংবাদে সারা দেশে মানুষের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। এতে করে মানুষের হাতে নগদ টাকার সরবরাহ বেড়েছে। যা দেশের মূল্যস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে দিবে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter