দৈনিক সহযাত্রী

শিরোনাম

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং আমাদের যে শিক্ষা দিয়ে গেল

আমাদের দুটি নতুন ও ভিন্ন অভিজ্ঞতার দিন গেল। ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মাঝ-বরাবর উপকূল অতিক্রম করেছিল ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। ২৫ অক্টোবর ঘুম থেকে জেগে শুনি চলে গেছে। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, বিপদ-আপদের দেশ হলেও আগে থেকেই এখন এসব তথ্য জনপরিসরে জানাজানি হয়ে যায়। কিন্তু দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বে ‘রোল মডেল’ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে এবার তেমন আগামবার্তা নেই, পূর্বাভাস নেই, জনপরিসরে প্রস্তুতি নেই। যেন দুম করে এক আপদ আছড়ে পড়ল, আর প্রস্তুতির আগেই ‘দুর্বল’ হয়ে সরে গেল।
অবশ্য চট্টগ্রাম, পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরে ৭ নং এবং কক্সবাজারে ৬ নং বিপদ সংকেত জারি হয়। নৌযান সব ঘাটে ও তীরে ভিড়ে। বহু এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনটি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরে বিমান চলাচল বন্ধ করা হয়। বহু এলাকায় ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্কে সমস্যা হয়। মূলত সিত্রাং যেদিন বাংলাদেশে আঘাত হানে, তার মাত্র আগের দিন থেকে রাষ্ট্রীয় তৎপরতা শুরু হয়।
২০০৭ সালের সিডর-পরবর্তী প্রায় প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের প্রেক্ষাপট বিশ্নেষণে দেখা যায়, আগাম সতর্কবার্তা ও প্রস্তুতি গ্রহণে বাংলাদেশ অনেক সক্রিয় হয়েছে। কিন্তু সিত্রাংয়ের ক্ষেত্রে এক নিদারুণ বিরল ঘটনা ঘটল। জান বাঁচাতে আমাদের একেবারে নাকেমুখে প্রস্তুতি নিতে হলো। প্রতিটি আপদ এক গভীরতম দাগ রেখে যায়। এই দাগের গভীরে বেঁচে থাকার বহু রসদ জীবন্ত থাকে। প্রতিটি ঘূর্ণিঝড় নতুন করে আমাদের কিছু শেখাতে চায়। কিছু জানান দেয়, কিছু ইঙ্গিত করে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংও আমাদের জন্য কিছু শিক্ষাবার্তা রেখে গেছে। এসব শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে বহুমুখী ও জনমুখী করে গড়ে তোলা জরুরি। সতর্কতা, সচেতনতা ও প্রস্তুতি- এসব গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু সবচেয়ে জরুরি হলো, দুর্যোগ মোকাবিলায় দায়িত্বশীল হওয়া। কারণ দুর্যোগ মোকাবিলা একজন ব্যক্তি বা একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানের বিষয় নয়।
বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি একটি বহুস্তরীয় এবং সমাজের প্রায় প্রতিনিধিত্বমূলক কাঠামো। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার এমন একটি কাঠামোর শক্তিই প্রতিনিয়ত দুর্যোগ সামাল দিতে আমাদের দক্ষ করে তুলছে। এমনকি সিত্রাংয়ের খবর খুব কম সময়ের ভেতর জানার পরও বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড় সামাল দিতে জানবাজি রেখেছে। এত কিছুর পরেও সিত্রাং নিয়ে আমরা দায়িত্বশীল ছিলাম না কেন? কেন আমরা এই ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য আগে থেকে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে পারলাম না? কৃষিসহ সব পেশাজীবী ও প্রতিষ্ঠানকে আরও ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করতে পারলাম না?
সংবাদমাধ্যমসূত্রে জানা যায়- আবহাওয়া অধিদপ্তর ১ অক্টোবর দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে অক্টোবর মাসের শেষের দিকে একটি ঘূর্ণিঝড়ের শঙ্কার কথা জানায়। কিন্তু ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর (আইএমডি) ১৯ অক্টোবর থেকেই সিত্রাং ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য আপডেট করলেও বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর নিম্নচাপ সৃষ্টির তথ্য ছাড়া আর আপডেট করেনি। এমনকি ২১ অক্টোবরও ঘূর্ণিঝড় নিয়ে কোনো তথ্য ছিল না আবহাওয়া অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে। পরদিন আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, সিত্রাং বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করবে কিনা তারা নিশ্চিত নয়। যদিও ভারতের কেন্দ্রীয় ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতি হিসেবে তারও আগে উপকূলীয় অঞ্চলে কর্মসূচি শুরু করে এবং কৃষকদের সতর্ক করে।
২৩ অক্টোবর এসে সচিবালয়ে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতিবিষয়ক জরুরি সভা করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী। ২৪ অক্টোবর দুপুরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে জানানো হয়, সিত্রাং এদিন সন্ধ্যায়ই উপকূলে আঘাত হানতে পারে। তবে একই দিন সন্ধ্যায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক সংবাদমাধ্যমকে জানান, সন্ধ্যায় নয়; সিত্রাং মধ্যরাতে আঘাত হানতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় যখন বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে তখন, ২৩ অক্টোবর, কৃষি মন্ত্রণালয় জরুরি বৈঠক করে যেসব এলাকায় আমন মৌসুমের ৮০ শতাংশ ধান পেকেছে তা কাটার পরামর্শ দেয়। ব্রি কিংবা কৃষি বিভাগ এত তড়িঘড়ি করে যে পরামর্শ দিল ঘূর্ণিঝড়ের সময়, তা কি বাংলাদেশের কৃষকদের পক্ষে পালন করা সম্ভব? সিত্রাংয়ে বিনষ্ট আমন ফসলের দায় কে নেবে?
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং আমাদের শিক্ষা দেয়- অবশ্যই আবহাওয়া বার্তা খুব ভালোভাবে বিশ্নেষণ করা জরুরি। নিয়মিত ও সহজভাবে দেশের সব অঞ্চলে, এমনকি আঞ্চলিক ও আদিবাসী ভাষায় এসব আগামবার্তা ও পূর্বাভাস সবাইকে জানানো জরুরি। যত বেশি পূর্বাভাস তত বেশি স্বাচ্ছন্দ্যময় কার্যকর প্রস্তুতি। যত বেশি আগামবার্তা তত বেশি চিন্তাভাবনার দুয়ার খোলে; তখন প্রস্তুতি মানবিক ও প্রাণবিক হয়। তা না হলে মানুষ জান বাঁচাতে কেবল নিজের সংসার নিয়ে ছুটে; প্রতিবেশীর দিকে তাকায় না। বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ, প্রবীণ, অন্তঃসত্ত্বা, আদিবাসী, দলিত, অসুস্থ, শিশু পেছনে থেকে যায়। গবাদি পশু, বুনোপ্রাণের দিকে ধেয়ে আসা জলোচ্ছ্বাসের সময় তাকানোর সময় থাকে না।
এবার সিত্রাংয়ের পূর্বাভাস নিয়ে বেশকিছু আলাপ-তর্ক উঠেছে। জানা যায়, কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সহকারী ও আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ গত ৯ অক্টোবর ফেসবুকে সুপার সাইক্লোনের আঘাতের কথা জানান। ফেসবুক পোস্টটি নিয়ে অনেক সংবাদমাধ্যম সংবাদ পরিবেশন করে। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছিল- অক্টোবর মাসে সাগরে লঘুচাপ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও সেটি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেবে কিনা তা সুনির্দিষ্ট করে তখনও বলা সম্ভব নয়। সংবাদমাধ্যমকে পলাশ বলেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্নেষণ করে ১৬ দিন আগে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের পূর্বাভাস তিনি দিতে পেরেছেন। তাহলে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর কেন পারে না?
ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে মঙ্গলবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন- সিত্রাংয়ের প্রভাবে দেশের ৪১৯টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ে দেশের প্রতিটি অঞ্চলের শ্রেণি-বর্গ-লিঙ্গ-জাতি-পেশা ভিন্নতায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, তাকে কেবল কাঠামোগত অর্থনীতির আয়নায় দেখা উচিত নয়। বরং সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পরিবেশগত জীবনের সব আঙ্গিক থেকে বিবেচনা করা জরুরি।

পাভেল পার্থ: লেখক ও গবেষক
animistbangla@gmail.com

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter